Sunday, April 5, 2020

করোনা ভাইরাস ও আমাদের কর্মফল



শাবান মাস এর (ফযিলত ও আমল)

শাবান মাস এর (ফযিলত ও আমল)


প্রিয় নবীর মাস- শাবান

রাসুলে আকরাম, নূরে মুজাস্সম  এর শাবানুল মুয়াযযাম সম্পর্কে সম্মানিত ফরমান হচ্ছে: “শাবান আমার মাস আর রমযান আল্লাহর মাস”।
(আল জামিউস্ সগীর, ৩০১ পৃষ্ঠা, হাদীস নং- ৪৮৮৯, দারুল কুতুবুল)

সাহাবায়ে কিরাম رضى الله عنهم এর প্রেরণা

হযরত সয়্যিদুনা আনাস বিন মালিক رضى الله عنه বলেন: শাবান মাসের চাঁদ দৃষ্টি গোচর হতেই সাহাবায়ে কিরাম رضى الله عنهم  কুরআনে পাকের তিলাওয়াতের প্রতি খুব বেশী মনোযোগী হতেন, নিজেদের ধন-সম্পদের যাকাত বের করে নিতেন (আদায় করতেন) যাতে অক্ষম ও মিসকীন লোকেরা রমযান মাসে রোযা রাখার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতে পারে। শাসকগণ বন্দীদের তলব করে যার উপর শাস্তি কার্যকর করা প্রয়োজন তার উপর শাস্তি কার্যকর করতেন আর অন্যান্যদেরকে মুক্তি দিয়ে দিতেন। ব্যবসায়ীগণ তাদের কর্জ পরিশোধ করতেন, অন্যান্যদের থেকে বকেয়া টাকা আদায় করে নিতেন (এভাবে রমযান মাসের চাঁদ উদিত হবার পূর্বেই নিজেকে অবসর করে নিতেন) আর রমযান এর চাঁদ দৃষ্টিগোচর হতেই গোসল করে (অনেকে) ইতিকাফে বসে যেতেন। (গুনইয়াতুত্ব ত্বালিবীন, ১ম খন্ড, ৩৪১ পৃষ্ঠা) 

বর্তমান যুগের মুসলমানদের আগ্রহ:

سُبحَان الله عَزَّوَجَل ! পূর্ববর্তী মুসলমানদের মধ্যে ইবাদতের প্রতি কিরূপ আগ্রহ ছিল। কিন্তু আফসোস বর্তমান যুগের মুসলমানদের সম্পদের প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি পেয়েছে। মাদানী চিন্তা-ধারার অধিকারী পূর্ববর্তী মুসলমানগণ বরকতময় দিনগুলোতে আল্লাহ তাআলার ইবাদত অধিক পরিমাণে করে তাঁর নৈকট্য অর্জনের চেষ্টা করতেন, আর বর্তমানের মুসলমানগণ মোবারক দিনগুলোতে বিশেষ করে রমযান শরীফে দুনিয়ার হীন সম্পদ অর্জন করার নতুন নতুন ফন্দি আবিষ্কারের চিন্তা-ভাবনায় মগ্ন থাকে। আল্লাহ তাআলা আপন বান্দাদের প্রতি দয়া পরবশ হয়ে নেকী সমূহের সাওয়াব ও প্রতিদান অতিমাত্রায় বৃদ্ধি করে দেন। কিন্তু দুনিয়ার সম্পদে মত্ত লোকেরা রমযানুল মোবারকে নিজেদের পণ্য সামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধি করে নিজ মুসলমান ভাইদের মধ্যে লুটতরাজ শুরু করে দেয়। শত কোটি আফসোস! মুসলমানদের কল্যান কামনার আগ্রহ বিলীন হতে দেখা যাচ্ছে! 

আক্বা  শাবান মাসে অধিক রোযা রাখতেন

বুখারী শরীফে রয়েছে: হযরত সায়্যিদাতুনা আয়িশা সিদ্দিকা رضى الله عنها বলেন: রাসুলুল্লাহ  শাবান মাসের চেয়ে অধিক রোযা অন্য কোন মাসে রাখতেন না। বরং সম্পূর্ণ শাবান মাসই রোযা রেখে নিতেন এবং ইরশাদ করতেন: “নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী আমল কর, কারণ আল্লাহ তাআলা ততক্ষণ নিজের দয়া বন্ধ করেন না, যতক্ষণ তোমরা ক্লান্ত না হও।” (সহীহ বুখারী, ১ম খন্ড, ৬৪৮ পৃষ্ঠা, হাদীস নং- ৯৭০, দারুল কুতুবুল ইলমিয়্যাহ, বৈরুত)

হাদীস শরীফের ব্যাখ্যা

বুখারী শরীফের ব্যাখ্যাকারী হযরত আল্লামা মুফতি মুহাম্মদ শরীফুল হক আমজাদী رحمة الله عليه এ হাদীসে পাকের টীকায় লিখেন: এখানে উদ্দেশ্য হচ্ছে, শাবানে অধিকাংশ দিন রোযা রাখতেন, এতে আধিক্যকে সারা মাস রোযা রাখা হিসাবে ব্যাখ্যা করেছেন। যেমন: বলা হয়, ‘অমুক সারা রাত ইবাদত করেছেন’ অথচ সে রাতে খানাও খেয়েছেন প্রয়োজনীয় কাজও করেছেন, এখানে আধিক্যকে সম্পূর্ণ বলা হয়েছে। তিনি আরো বলেন: এ হাদীস শরীফ থেকে জানা গেল, শাবান মাসে যে শক্তি রাখে, সে যেন বেশী পরিমানে রোযা রাখে কিন্তু যে দূর্বল হয় সে যেন রোযা না রাখে। কেননা এতে রমজানের রোযার উপর প্রভাব পড়বে। যে হাদীস গুলোতে বলা হয়েছে: অর্ধ শাবানের পর রোযা রাখিওনা, সেখানে এটাই উদ্দেশ্যে। (তিরমিযী, হাদীস নং- ৭৩৮, নুযহাতুলক্বারী, ৩য় খন্ড, ৩৭৭, ৩৮০ পৃষ্ঠা, ফরিদ বুক স্টল, মরকাযুল আউলিয়া লাহোর)

শাবান মাসে বেশী পরিমানে রোযা রাখা সুন্নাত:

উম্মুল মু’মিনীন হযরত সায়্যিদাতুনা আয়িশা সিদ্দিকা رضى الله عنها বর্ণনা করেন: হুযুর আকরাম, নূরে মুজাস্সম, শাহে বনী আদম, রাসুলে মুহতাশাম, শফিয়ে উমাম  কে আমি শাবান মাসের চেয়ে বেশী রোযা অন্য কোন মাসে রাখতে দেখিনি। তিনি ﷺ কিছু দিন ব্যতীত সম্পূর্ণ মাসই রোযা রাখতেন। (সুনানে তিরমিযী, ২য় খন্ড, ১৮২ পৃষ্ঠা, হাদীস নং- ৭৩৬, দারুল ফিক্র, বৈরুত)
তেরি সুন্নাতো পে চল কর মেরি রূহ জব নিকল কর,
চলে তুম গলে লাগানা মাদানী মদীনে ওয়ালে।

কল্যাণময় রাত সমূহ:

উম্মুল মু’মিনীন হযরত সায়্যিদাতুনা আয়িশা সিদ্দিকা رضى الله عنها বলেন: আমি রাসুলে করীম, রউফুর রহীম, হুযুর পুরনূর ﷺ কে ইরশাদ করতে শুনেছি, আল্লাহ তাআলা (বিশেষত) চারটি রাতে কল্যাণের দরজা খুলে দেন। 
(১) কুরবানীর ঈদের রাত, 
(২) ঈদুল ফিতরের রাত, 
(৩) শাবানের ১৫তম রাত। এই রাতে মৃত্যুবরণকারীদের নাম ও মানুষের রিয্ক (জীবিকা) এবং (এ বৎসর) হজ্ব পালনকারীদের নাম লিখা হয়, 
(৪) আরাফাহ (অর্থাৎ যিলহজ্জের ৮ ও ৯ তারিখে) এর রাত (ফজরের) আযান পর্যন্ত। (তাফসীরে দূররে মানসুর, ৭ম খন্ড, ৪০২ পৃষ্ঠা, দারুল ফিকর, বৈরুত)

নাজুক ফয়সালা:

প্রিয় ইসলামী ভাইয়েরা! ১৫ই শাবানুল মুয়াযযমের রাতটি কতই নাজুক। জানিনা অদৃষ্টে কি লিখে দেয়া হয়। অনেক সময় বান্দা উদাসীন অবস্থায় থাকে আর অপরদিকে তার ব্যাপারে কত কিছুই হয়ে যাচ্ছে। যেমন- “গুনইয়াতুত তালিবীন” এ রয়েছে: অনেক কাফন ধুয়ে তৈরী করে রাখা হয় কিন্তু কাফন পরিধানকারী বাজার সমূহে ঘোরা-ফেরায় রত থাকে, অনেক লোক এমনই রয়েছে, যাদের জন্য কবর খনন করে তৈরী করা হচ্ছে কিন্তু এগুলোতে যারা দাফন হবার অপেক্ষায় রয়েছে তারা হাসি-খুশীতে বিভোর হয়ে থাকে, অনেক লোক হেসে যাচ্ছে অথচ তাদের মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে এসেছে। বহু দালানের নির্মাণ কাজ পরিপূর্ণ হতে চলেছে কিন্তু দালানের মালিকের মৃত্যুকালও পূর্ণ হয়ে গেছে।
(গুনইয়াতুত তালিবীন, ১ম খন্ড, ৩৪৮ পৃষ্ঠা)

মানুষ এটা থেকে উদাসীন:

হযরত সায়্যিদুনা ওসামা বিন যায়দ رضى الله عنه বলেন: আমি আরয করলাম: হে আল্লাহর রাসুল  আমি দেখেছি, যেভাবে আপনি শাবান মাসে রোযা রাখেন সেভাবে অন্য কোন মাসে (রোযা) রাখেন না? তিনি ইরশাদ করলেন: “রজব ও রমযান এর মধ্যবর্তী এ মাস রয়েছে। লোকেরা এটার থেকে উদসীন। এ মাসে মানুষের আমল সমূহ আল্লাহ তাআলার কাছে নেয়া হয় আর আমি এটা পছন্দ করি যে, আমার আমল এ অবস্থাতে উঠানো হোক যখন আমি রোযা অবস্থায় থাকি।” (সুনানে নাসায়ী, ৩৮৭ পৃষ্ঠা, হাদীন নং- ২৩৫৪, দারুল কুতুবুল ইলমিয়্যাহ, বৈরুত)

মৃত্যুবরণ কারীদের তালিকা তৈরির মাস

হযরত সায়্যিদাতুনা আয়িশা সিদ্দিকা رضى الله عنها বলেন: রহমতে আলম, নূরে মুজাস্সম, রাসুলে আকরাম  সম্পূর্ণ শাবান মাসে রোযা রাখতেন। তিনি বলেন; আমি আরয করলাম: হে আল্লাহর রাসুল  সকল মাসের মধ্যে কি আপনার ﷺ নিকট শাবানের রোযা রাখা অধিক পছন্দনীয়? তখন আল্লাহর হাবীব, হাবীবে লবীব, রাসুলুল্লাহ  ইরশাদ করেন: “আল্লাহ তাআলা এ বৎসরে মৃত্যুবরণকারী প্রতিটি আত্মার নাম (এ মাসে) লিখে দেন আর আমি এটা পছন্দ করি যে, আমার বিদায়ের সময় (যখন) আসবে (তখন যেন) আমি রোযা অবস্থায় থাকি।” (মুসনাদে আবি ইয়ালা, ৪র্থ খন্ড, ২৭৭ পৃষ্ঠা, হাদীস নং- ৪৮৯০, দারুল কুতুবুল ইলমিয়্যাহ, বৈরুত)

Thursday, April 2, 2020

যাকাত পাবে কারা?

যাকাত পাবে কারা?



মহান আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআন মাজীদে যাকাত প্রদানের ৮টি খাত উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন,

‘নিশ্চয়ই ছাদাক্বাহ্ (যাকাত) হচ্ছে ফকীর ও মিসকীনদের জন্য এবং এতে নিয়োজিত কর্মচারীদের জন্য, আর যাদের অন্তর আকৃষ্ট করতে হয় তাদের জন্য; (তা বণ্টন করা যায়) দাস আযাদ করার ক্ষেত্রে, ঋণগ্রস্তদের মধ্যে, আল্ল­াহর রাস্তায় এবং মুসাফিরদের মধ্যে। এটি আল্লাহর পক্ষ হতে নির্ধারিত, আর আল্লাহ মহাজ্ঞানী, প্রজ্ঞাময়’ (তওবা ৯/৬০)

উক্ত আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা যাকাত প্রদানের ৮টি খাত উল্লেখ করেছেন। নিম্নে প্রত্যেকটি খাত আলাদাভাবে আলোচনা করা হল-

(১) ফকীর : নিঃসম্বল ভিক্ষাপ্রার্থী। যাকে আল্লাহ তা‘আলা যাকাতের ৮টি খাতের প্রথমেই উল্লেখ করেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রতিনিয়ত দারিদ্র্য থেকে আল্লাহর নিকটে আশ্রয় প্রার্থনা করতেন। তিনি বলতেন,

اللَّهُمَّ إِنِّيْ أَعُوْذُ بِكَ مِنَ الْكُفْرِ وَالْفَقْرِ

‘ হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট কুফরী ও দারিদ্র্য থেকে আশ্রয় চাচ্ছি’।[1]

অতএব ফকীর যাকাতের মাল পাওয়ার হকদার। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

‘তোমরা যদি প্রকাশ্যে ছাদাক্বাহ প্রদান কর তবে উহা ভাল; আর যদি তা গোপনে কর এবং দরিদ্রদেরকে দাও তা তোমাদের জন্য আরো ভাল’ (বাক্বারাহ ২/২৭১)

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

‘আল্লাহ তা‘আলা তাদের উপর তাদের সম্পদে ছাদাক্বাহ্ (যাকাত) ফরয করেছেন। যেটা তাদের ধনীদের নিকট থেকে গৃহীত হবে আর তাদের দরিদ্রের মাঝে বণ্টন হবে’।[2]

(২) মিসকীন : যাকাত প্রদানের ৮টি খাতের মধ্যে দ্বিতীয় খাত হিসাবে আল্লাহ তা‘আলা মিসকীনকে উল্লেখ করেছেন। আর মিসকীন হল ঐ ব্যক্তি যে নিজের প্রয়োজন মিটাতেও পারে না, মুখ ফুটে চাইতেও পারে না। বাহ্যিকভাবে তাকে সচ্ছল বলেই মনে হয়। হাদীছে এসেছে,

আবু হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, এমন ব্যক্তি মিসকীন নয় যে এক মুঠো-দু’মুঠো খাবারের জন্য বা দুই একটি খেজুরের জন্য মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়ায় এবং তাকে তা দেওয়া হলে ফিরে আসে। বরং প্রকৃত মিসকীন হল সেই ব্যক্তি যার প্রয়োজন পূরণ করার মত যথেষ্ট সঙ্গতী নেই। অথচ তাকে চেনাও যায় না যাতে লোকে তাকে ছাদাক্বাহ্ করতে পারে এবং সে নিজেও মানুষের নিকট কিছু চায় না।[3]

(৩) যাকাত আদায়কারী ও হেফাযতকারী : আল্লাহ তা‘আলা যাকাত প্রদানের তৃতীয় খাত হিসাবে ঐ ব্যক্তিকে উল্লেখ করেছেন, যে ব্যক্তি যাকাত আদায়, হেফাযত ও বণ্টনের কাজে নিয়োজিত। অতএব উক্ত ব্যক্তি সম্পদশালী হলেও সে চাইলে যাকাতের অংশ গ্রহণ করতে পারবে।[4]হাদীছে এসেছে,

ইবনু সায়ে‘দী আল-মালেকী (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) আমাকে যাকাত আদায়কারী হিসাবে নিযুক্ত করলেন। যখন আমি কাজ শেষ করলাম এবং তাঁর কাছে পৌঁছিয়ে দিলাম তখন তিনি নির্দেশ দিলেন আমাকে পারিশ্রমিক দেওয়ার জন্য। আমি বললাম, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যই আমি ইহা করেছি। সুতরাং আমি আল্লাহর নিকট থেকেই এর প্রতিদান নেব। তিনি বললেন, আমি যা দিচ্ছি তা নিয়ে নাও। কেননা আমিও রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সময় যাকাত আদায়কারীর কাজ করেছি। তখন তিনিও আমাকে পারিশ্রমিক প্রদানের নির্দেশ দিয়েছিলেন। তখন আমিও তোমার মত এরূপ কথা বলেছিলাম। রাসূল (ছাঃ) আমাকে বলেছিলেন, যখন তুমি না চাওয়া সত্ত্বেও তোমাকে কিছু দেওয়া হয়, তখন তুমি তা গ্রহণ কর। তুমি তা নিজে খাও অথবা ছাদাক্বাহ্ কর।[5]অন্য হাদীছে এসেছে,

আতা ইবনু ইয়াসার (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, সম্পদশালী ব্যক্তির জন্য যাকাত গ্রহণ হালাল নয়। তবে পাঁচ শ্রেণীর ধনীর জন্য তা জায়েয। (১) আল্লাহর পথে জিহাদরত ব্যক্তি। (২) যাকাত আদায়ে নিয়োজিত কর্মচারী। (৩) ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি। (৪) যে ব্যক্তি যাকাতের মাল নিজ মাল দ্বারা ক্রয় করেছে এবং (৫) মিসকীন প্রতিবেশী তার প্রাপ্ত যাকাত থেকে ধনী ব্যক্তিকে উপঢৌকন দিয়েছে।[6]

(৪) ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য কোন অমুসলিমকে যাকাত প্রদান করা : ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে অথবা কোন অনিষ্ট বা কাফেরের ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়ার লক্ষ্যে কোন অমুসলিমকে যাকাতের অর্থ প্রদান করা যায়।[7] হাদীছে এসেছে,

আবু সা‘ঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আলী (রাঃ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট কিছু স্বর্ণের টুকরো পাঠালেন। তিনি তা চার ব্যক্তির মাঝে বণ্টন করে দিলেন। (১) আল-আকরা ইবনু হানযালী যিনি মাজায়েশী গোত্রের লোক ছিলেন। (২) উআইনা ইবনু বাদার ফাযারী। (৩) যায়েদ ত্বায়ী, যিনি পরে বনী নাবহান গোত্রের ছিলেন। (৪) আলকামাহ ইবনু উলাছাহ আমেরী, যিনি বনী কিলাব গোত্রের ছিলেন। এতে কুরাইশ ও আনসারগণ অসন্তুষ্ট হলেন এবং বলতে লাগলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নজদবাসী নেতৃবৃন্দকে দিচ্ছেন আর আমাদেরকে দিচ্ছেন না। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আমি তো তাদেরকে আকৃষ্ট করার জন্য এমন মনরঞ্জন করছি। তখন এক ব্যক্তি সামনে এগিয়ে আসল, যার চোখ দু’টি কোটরাগত, গন্ডদ্বয় ঝুলে পড়া, কপাল উঁচু, ঘন দাড়ি এবং মাথা মোড়ানো ছিল। সে বলল, হে মুহাম্মাদ! আল্লাহকে ভয় করুন। তখন তিনি বললেন, আমিই যদি নাফরমানী করি তাহলে আল্লাহর আনুগত্য করবে কে? আল্লাহ আমাকে পৃথিবীবাসীর উপর আমানতদার বানিয়েছেন, আর তোমরা আমাকে আমানতদার মনে করছ না। তখন এক ব্যক্তি তাঁর নিকট তাকে হত্যা করার অনুমতি চাইল। (আবু সা‘ঈদ (রাঃ) বলেন, আমি তাকে খালিদ ইবনু ওয়ালিদ বলে ধারণা করছি। কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামতাকে নিষেধ করলেন। অতঃপর যখন অভিযোগকারী লোকটি ফিরে গেল, তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, এ ব্যক্তির বংশ হতে বা এ ব্যক্তির পরে এমন কিছু সংখ্যক লোক হবে তারা কুরআন পড়বে, কিন্তু তা তাদের কণ্ঠনালী অতিক্রম করবে না। দ্বীন হতে তারা এমনভাবে বের হয়ে যাবে যেমনি ধনুক হতে তীর বেরিয়ে যায়। তারা ইসলামের অনুসারীদেরকে হত্যা করবে আর মুর্তি পূজারীদেরকে হত্যা করা থেকে বিরত থাকবে। আমি যদি তাদেরকে পেতাম তাহলে তাদেরকে আদ জাতির মত অবশ্যই হত্যা করতাম।[8]

(৫) দাস মুক্তির জন্য : যারা লিখিত কোন চুক্তির বিনিময়ে দাসে পরিণত হয়েছে। তাদেরকে মালিকের নিকট থেকে ক্রয়ের মাধ্যমে মুক্ত করার লক্ষ্যে যাকাতের অর্থ প্রদান করা যায়। অনুরূপভাবে বর্তমানে কোন মুসলিম ব্যক্তি অমুসলিমদের হাতে বন্দি হলে সে ব্যক্তিও এই খাতের অন্তর্ভুক্ত হবে।[9]হাদীছে এসেছে,

বারা ইবনু আযেব (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট এসে বলল, আমাকে এমন একটি আমল বলে দিন যা আমাকে জান্নাতের নিকটবর্তী করবে এবং জাহান্নাম থেকে দূরে রাখবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, প্রশ্ন তো তুমি অল্প কথায় বলে ফেললে; কিন্তু তুমি অত্যন্ত ব্যাপক বিষয় জানতে চেয়েছ। তুমি একটি প্রাণী আযাদ করে দাও এবং একটি দাস মুক্ত করে দাও। লোকটি বলল, এ উভয়টি কি একই কাজ নয়? তিনি বললেন, না (উভয়টি এক নয়)। কেননা একটি প্রাণী আযাদ করার মানে হল, তুমি একাকী গোটা প্রাণীকে মুক্ত করে দিবে। আর একটি দাস মুক্ত করার অর্থ হল, তার মুক্তির জন্য কিছু মূল্য প্রাদানের মাধ্যমে সাহায্য করবে। (এদ্ভিন্ন জান্নাতে প্রবেশকারী কাজের মধ্যে অন্যতম হল) প্রচুর দুধ প্রদানকারী জানোয়ার দান করা এবং এমন নিকটতম আত্নীয়ের প্রতি অনুগ্রহ করা, যে তোমার উপর অত্যাচারী। যদি তুমি এ সমস্ত কাজ করতে সক্ষম না হও, ক্ষুদার্থকে খাদ্য দান কর এবং পিপাসিতকে পানি পান করাও। সৎ কাজের আদেশ এবং অসৎ কাজ হতে নিষেধ কর। আর যদি তোমার দ্বারা এ কাজ করাও সম্ভব না হয়, তবে কল্যাণকর কথা ব্যতীত অন্য কথা থেকে তোমার জিহবাকে সংযত রাখ।[10]

উল্লিখিত হাদীছে ইসলাম দাসমুক্তিকে জান্নাত লাভের বিশেষ মাধ্যম হিসাবে উল্লেখ করেছে। আর দাসমুক্তির জন্য যেহেতু প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হয়, সেহেতু আল্লাহ তা‘আলা ইসলামী অর্থনীতির প্রধান উৎস যাকাত বণ্টনের খাত সমূহের মধ্যে দাসমুক্তিকে উল্লেখ করেছেন।

(৬) ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি : ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিকে তার ঋণ থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে যাকাত প্রদান করা যাবে। হাদীছে এসেছে,
কাবীছা ইবনু মাখারেক (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একবার আমি কিছু ঋণের যিম্মাদার হয়েছিলাম। অতএব এ ব্যাপারে কিছু চাওয়ার জন্য আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট গেলাম। তিনি আমাকে বললেন, (মদ্বীনায়) আবস্থান কর যতক্ষণ পর্যন্ত আমার নিকট যাকাতের মাল না আসে। তখন আমি তা হতে তোমাকে কিছু দেওয়ার নির্দেশ দান করব। অতঃপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, মনে রেখ হে কাবীছা! তিন ব্যক্তি ব্যতীত অন্য কারো জন্য (যাকাতের মাল হতে) সাহায্য চাওয়া হালাল নয়। (১) যে ব্যক্তি কোন ঋণের যিম্মাদার হয়েছে তার জন্য (যাকাতের মাল হতে) সাহায্য চাওয়া হালাল যতক্ষণ না সে তা পরিশোধ করে। তারপর তা বন্ধ করে দিবে। (২) যে ব্যক্তি কোন বালা মুছীবতে আক্রান্ত হয়েছে যাতে তার সম্পদ ধ্বংস হয়ে গেছে তার জন্য (যাকাতের মাল হতে) সাহায্য চাওয়া হালাল যতক্ষণ না তার প্রয়োজন পূর্ণ করার মত অথবা তিনি বলেছেন, বেঁচে থাকার মত কোন কিছু লাভ করে এবং (৩) যে ব্যক্তি অভাবগ্রস্ত হয়েছে এমনকি তার প্রতিবেশীদের মধ্যে জ্ঞান-বুদ্ধি সম্পন্ন তিন জন ব্যক্তি তার দারিদ্র্যের ব্যাপারে সাক্ষী প্রদান করেছে তার জন্য (যাকাতের মাল থেকে) সাহায্য চাওয়া হালাল যতক্ষণ না সে তার জীবিকা নির্বাহের মত অথবা তিনি বলেছেন, বেঁচে থাকার মত কিছু লাভ করে। হে কাবীছা! এরা ব্যতীত যারা (যাকাতের মাল থেকে) চায় তারা হারাম খাচ্ছে।[11]

(৭) আল্লাহর রাস্তায় : আল্লাহর দ্বীনকে সমুন্নত করার লক্ষ্যে যে কোন ধরনের প্রচেষ্টা ‘ফী সাবীলিল্লাহ’ বা আল্লাহর রাস্তার অন্তর্ভুক্ত। জিহাদ, দ্বীনী ইলম অর্জনের যাবতীয় পথ এবং দ্বীন প্রচারের যাবতীয় মাধ্যম এ খাতের অন্তর্ভুক্ত। হাদীছে এসেছে,

আতা ইবনু ইয়াসার (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, সম্পদশালী ব্যক্তির জন্য যাকাত গ্রহণ হালাল নয়। তবে পাঁচ শ্রেণীর ধনীর জন্য তা জায়েয। (১) আল্লাহর পথে জিহাদরত ব্যক্তি। (২) যাকাত আদায়ে নিয়োজিত কর্মচারী। (৩) ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি। (৪) যে ব্যক্তি যাকাতের মাল নিজ মাল দ্বারা ক্রয় করেছে এবং (৫) মিসকীন প্রতিবেশী তার প্রাপ্ত যাকাত থেকে ধনী ব্যক্তিকে উপঢৌকন দিয়েছে।[12]

(৮) মুসাফির : সফরে গিয়ে যার পাথেয় শেষ হয়ে গেছে সে ব্যক্তিকে যাকাতের অর্থ প্রদান করে বাড়ী পর্যন্ত পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে যাকাতের অর্থ দান করা যাবে। এক্ষেত্রে উক্ত মুসাফির সম্পদশালী হলেও তাকে যাকাত প্রদান করা যাবে।


ফুটনোটঃ [1]. আবুদাউদ হা/৫০৯০; নাসাঈ হা/১৩৪৭; মিশকাত হা/২৪৮০। [2]. বুখারী হা/১৩৯৫, ‘যাকাত’ অধ্যায়, ‘যাকাত ওয়াজিব হওয়া’ অনুচ্ছেদ, বঙ্গানুবাদ বুখারী ২/৭৫ পৃঃ; মুসলিম হা/১৯। [3]. বুখারী হা/১৪৭৯, ৪৫৩৯; মুসলিম হা/১০৩৯; মিশকাত হা/১৮২৮। [4]. শারহুল মুনতে ৬/২২৫। [5]. মুসলিম হা/১০৪৫; মিশকাত হা/১৮৫৪। [6]. আবুদাউদ হা/১৬৩৫; মিশকাত হা/১৮৩৩; আলবানী, সনদ ছহীহ; ছহীহুল জামে‘ হা/৭২৫০। [7]. শারহুল মুনতে ৬/২২৬। [8]. বুখারী হা/৩৩৪৪, বঙ্গানুবাদ বুখারী, (তাওহীদ পাবলিকেশন্স) ৩/৩৮০ পৃঃ; মুসলিম হা/১০৬৪। [9]. শারহুল মুনতে ৬/২৩০। [10]. মুসনাদে আহমাদ হা/১৮৬৭০; আদাবুল মুফরাদ হা/৬৯; মিশকাত হা/৩৩৮৪, বঙ্গানুবাদ মিশকাত (এমদাদিয়া) ৭/৩ পৃঃ; আলবানী, সনদ ছহীহ। [11]. মুসলিম হা/১০৪৪; মিশকাত হা/১৮৩৭। [12]. আবুদাউদ হা/১৬৩৫; মিশকাত হা/১৮৩৩; আলবানী, সনদ ছহীহ; ছহীহুল জামে‘ হা/৭২৫০।